সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কমান্ডো অভিযান - আসাদ বিন হাফিয -ক্রুসেড পর্ব ২ - ফ্রী পি ডি এফ ডাউনলোড করুন

সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কমান্ডো অভিযান - আসাদ বিন হাফিয -ক্রুসেড পর্ব ২ - ফ্রী পি ডি এফ ডাউনলোড করুন

নিচে এই বই টির ডাউনলোড করার দুইটি লিঙ্ক আছে এবং প্রিভিউ লিঙ্ক ও আছে

কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন নিচে আমার ফেসবুক আইডি এর লিঙ্ক দেওয়া আছে.. যদি কোনো ভুল হয় ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন

বই রিভিউ - রূপের ফাঁদে

কায়রো থেকে দু’মাইল দূরে এক বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের এক দিবে বালিয়াড়ি, ছোট ছোট পাহাড়। বাকি তিন দিকে দিগন্ত বিস্তৃত বালুর সমুদ্র।

এ মাঠ আজ লাখো মানুষের পদভারে কম্পিত। উট, ঘোড়া আর গাধায় চড়ে এসেছে মানুষ। তবে বেশীর ভাগ এসেছে পায়ে হেঁটে। চার পাঁচ দিন থেকে জমা হচ্ছে দর্শক। ভিড়ের চাপে দলিত মথিত হচ্ছে কায়রোর বাজার। সরাইখানায় উপচে পড়া ভিড়।

এরা এসেছে সরকারী ঘোষণা শুনে। এক হস্তা পর অনুষ্ঠিত হবে সামরিক মহড়া। মিসরের সেনাবাহিনী ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজী, অসিখেলা সহ বিভিন্ন যুদ্ধের খেলা দেখাবে। অসামরিক লোকও এসব খেলায় অংশ নিতে পারবে।

এতে সালাহউদ্দীন আয়ুবীর দু’টো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত, যারা মিসরের সেনাবাহিনীকে দুর্বল ভাবছে তাদের ভুল ধারণা দূর করা।

পাঁচ-ছ’ দিন আগে থেকেই লোকজন আসছে। এতে সালাহউদ্দীন আয়ুবী বেজায় খুশী। দর্শক এক লাখ হলে নতুন সেনা ভর্তি হবে পাঁচ হাজার।

কিন্তু সরকারী এ ঘোষণায় আলী ছিলেন উদ্বিগ্ন।

মাননীয় সুলতান!” বললেন তিনি ‘এক লাখ দর্শক হলে এর মধ্যে এক হাজার থাকবে শক্রর গুপ্তচর। মেয়েরা আসছে গ্রাম থেকে। এদের বেশীর ভাগ সুদানী। সুদানী মেয়েরা অত্যন্ত ফর্সা, খ্রিস্টান মেয়েরা অনায়াসে এদের সাথে মিশে যেতে পারবে।’

তোমার সমস্যা আমি বুঝতে পারছি আলী। কিন্তু এ মহড়া কেন জরুরী তা তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তোমার সংস্থার তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দাও।”

আমি মেলার বিপক্ষে নই সুলতান। এটা যে খুবই প্রয়োজন তাও বুঝি। আপনাকে উৎকণ্ঠায় ফেলতে চাইনি, মেলা কি সমস্যা নিয়ে আসছে তাই শুধু বলতে চাইছি।

কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিনি পতিতালয়। এ সব পতিতালয় রাতভর খদ্দেরে পূর্ণ থাকে।

শহরের বাইরেও কিছু তাঁবু টানানো হয়েছে। আমার ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী কিছু তাবু রয়েছে ভাসমান পতিতাদের। সারারাত নাচগানের আসর জমজমাট থাকে ওসব তাবুতে। আগামীকাল মেলা, এর মধ্যে নর্তকীরা দর্শকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রচুর অর্থ।

মেলা শেষ হয়ে গেলে এসব থাকবে না। এর ওপর আমি কোন বিধি নিষেধ আরোপ করতে চাই না। মিসরীদের নৈতিক চরিত্র উন্নত নয়। দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক আবহ দু’একদিনে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

সেনাবাহিনীতে লোক বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য আমার প্রচুর দর্শক প্রয়োজন। তুমি জান আলী আমাদের অনেক সৈন্য প্রয়োজন। সামরিক এবং বেসামরিক অফিসারদের বৈঠকেও আমি এ দিকটা ব্যাখ্যা করেছি।

মিটিংয়ে আপনি বড় বেশী খোলামেলা আলোচনা করেছেন। আপনাকে এ থেকে বিরত রাখতে পারিনি সুলতান। আমার গোয়েন্দা দৃষ্টি বলছে, এসব অফিসারদের অর্ধেক আপনার অনুগত নয়। আপনি জানেন, অনেকে আপনাকে সইতে পারছে না। কারো কারো আন্তরিকতা ও আনুগত্য রয়েছে সুদানীদের সাথে। আমি এদের পেছনে একজন করে টিকটিকি লাগিয়ে রেখেছি। ওরা নিয়মিত আমাকে খোঁজ খবর দিচ্ছে।”

কোন বিপজ্জনক তৎপরত কি ধরা পড়েছে?

‘না, তবে পদমর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে এরা রাতে সন্দেহজনক তাবু এবং মিনি পতিতালয, লোতে যাতায়াত করে। দু’জন তো দুটি নর্তকীকে বাদীতেই নিয়ে এসেছ। অন্যদিকে আমার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দু’টি পাল তোলা নৌকা, দশদিন আগে নৌকাগুলো রোম উপসাগরের পাড়ে দেখা শে-চ। –

“এ তে বিশেষ এমন কি রয়েছে?”

স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ওদের তৎপরতা রহস্যজনক। ওখানকার সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার পর দু’জন করে বিভিন্ন স্থানে পাহারা বসানো হয়েছে। খ্রিস্টানরা যেন আকস্মিক আক্রমণ করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা বিভাগের কিছু লোক স্থানীয় বেদুঈন এবং জেলেদের পোশাকে ওখানে ঘোরাফিরা করছে। কিন্তু বিশাল সাগর সৈকতে নজর রাখার জন্য এদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। বিশেষ করে। যেখানে যেখানে সাগর থেকে চ্যানেল ভেতরে ঢুকেছে সে এলাকায় নজর রাখা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়।

দিন দশেক আগে একটা চ্যানেল থেকে দু’টাে পাল তোলা নৌকাকে বেরোতে দেখা গেছে। হয়ত রাতে এসেছিল। দু’জন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার ছুটে গিয়েও ওদের ধরতে পারেনি, নৌকা দু’টো তখন সাগরের বেশ ভেতরে চলে গেছে। ওগুলো জেলে নৌক ছিল না। নিশ্চয়ই সাগরের ওপার থেকে এসেছিল।

আমাদের সৈন্যরা পাহাড়ের ফাক ফোঁকড় এবং মরুভূমির বিশাল এলাকা খুঁজেও কিছুই পায়নি। নৌকায় কারা ছিল, কেন এসেছে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল মরুভূমিতে ওদের খুঁজে বের করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভবও।

আলী আরো বলল, দেড়মাস থেকে মেলার সংবাদ প্রচার কর হচ্ছে। এ খবর ইউরোপ পর্যন্ত পৌছা বিচিত্র নয়। সংবাদ পেলে ওদের গোয়েন্দারা আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কায়রোতে মেয়ে কেন বেচা শুরু হয়েছে। ক্রেতারা সাধারণ নাগরিক নয়। ব্যবসায়ী, প্রশাসক এবং সেনাবাহিনীর পদস্থ ব্যক্তি ও পতিতাদের দালালরা এসব মেয়েদের কিনছে। এদের মধ্যে খ্রিস্টান মেয়েও থাকতে পারে, শুধু পারে না, আমি মনে করি অবশ্যই আছে।

এসব সংবাদে সালাহউদ্দীন আয়ুবী উৎকষ্ঠিত হলেন না।

রোম উপসাগরের পাড়ে খ্রিস্টানশক্তি পরাজিত হয়েছে বছর খানেক আগে। ওখানে এখন কোন ছাউনিও নেই। আলী বিন সুফিয়া কিছু গোয়েন্দা নিয়োগ করলেও ওরা তেমন শক্তিশালী নয়। সংবাদ এসেছে খ্রিস্টান গুপ্তচরে ছেয়ে গেছে মিসর।

মিসরের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা এখনও জনা যায়নি শোনা যায় বাগদাদ এবং দামেশকে ওদের তৎপরতা বেশী। বিশেষ করে সিরিয়ার মুসলিম আমীর-ওমরারা মদ আর বিলাসিতায় ডুবে যাচ্ছে।

রোম উপসাগরের যুদ্ধের সময় নুরুদ্দীন জংগী খ্রিস্টান রাজ্য আক্রমণ করে ওদের সন্ধি করতে বাধ্য করেছিলেন। বন্দিদের মধ্যে রিনান্ট নামের একজন সেনাপতিও ছিল। ওরা মুসলমান বন্দীদের হত্যা করায় জঙ্গী ওদের ছাড়েননি।

সুলতান জংগী মুসলিম বিশ্বকে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইয়ুবীর এ বিশ্বাস ছিল। তবুও ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করার জন্য তিনি সেনাবাহিনী তৈরি করছিলেন। তিনি চাইছিলেন মিসরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার সাথে সাথে আরবকে মুক্ত করতে। একই সময়ে আক্রমণ এবং মিসরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অটুট রাখার জন্য প্রচুর সৈন্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেমত নতুন সেনা ভর্তি হচ্ছিল না।

পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তার বিরোধী শক্তি ছিল প্রবল আনুগত্য ছিল যৎসামান্য। নূরুদ্দিন জংগী কিছু সৈন্য পাঠিয়েছিলেন মিসরের একটি ফৌজ তৈরী হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো দেখেনি। সুলতান আয়ুবীকেও দেখেনি ওরা। এজন্যই মেলার আয়োজন।

মেলার সময় অফিসার এবং কমান্ডারদের তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মেশার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন ওদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে। ‘ওদের বোঝাতে হবে আমরা সবাই এক। সবাই চাই আল্লাহ এবং রসূলের দ্বীনকে প্রসারিত করে এ ভূখন্ডকে খ্ৰীষ্টানদের আধিপত্য মুক্ত করতে।’

মেলার আগের দিন আলী সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে বললেন, সুলতান, শক্রর গুপ্তচরদের আমি ভয় পাই। যেসব মুসলিম ভায়েরা বেঈমানদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে, তাদের নিয়ে আমি শংকিত। এদের ঈমান দৃঢ় হলে চরদের সমগ্র বাহিনীও আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারতো না। নবাগতা নর্তকীদের দিয়ে ওরা জাল ফেলছে। এরপরও আমার বাহিনী দিনরাত তৎপর রয়েছে।

তোমার লোকদের বলো দুশমনের চরদের হত্যা না করে জীবিত গ্রেফতার করতে। ওরা শক্রর জন্য চোখ এবং কান কিন্তু আমাদের জনা ভাষা। ওদের কাছ থেকে তুমি সব খবর সংগ্রহ করতে পারবে।

○○○

মেলার দিনের সূর্য হেসে উঠল পূর্বকাশে শাল বিস্তীর্ণ মাঠের তিন দিকে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়! পাহাড়ের দিক সংরক্ষিত ওদিকে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি।

বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। বন্যার উত্তাল সাগরের গর্জনের ন্যায় ভেসে এল অশ্বক্ষুরধ্বনি। ধুলোয় ভরে গেল আকাশ। দু’হাজারের ও পেশ সড়ি ছুটে আসছে তীব্র গতিতে।

থম ঘোড়া মাঠে প্রবেশ করল। আরোহী সালাহউদ্দীন আয়ুবী।

তার দু’পাশে পতাকাবাহী। পেছনে অশ্বারোহী দল।

ঘোড়ার পিঠ রঙীন চাদরে সুশোভিত। আরোহীদের হাতে বশ। কোমরে তরবারী। বর্শার মাথায় রঙীন কাপড়ের তৈরী ছোট ছোট ঝাণ্ডা। মাঠে প্রবেশ করেই গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। দুলকি চালে এগুচ্ছে ঘোড়াগুলো। সওয়াররা বসে আছে মাথা উচিয়ে। টানটান বুক। চোখে মুখে দৃঢ়তা।

নিস্তব্ধতা নেমে এল দর্শকদের মাঝে। অর্ধ বৃত্তের মত দাড়িয়ে আছে দর্শক। পেছনের দর্শকরা ঘোড়ার পিঠে। তারও পেছনে উট। প্রতিটাতে দুতিন জন করে দর্শক।

দাঁড়ানো দর্শকদের সামনে একখানে চাদোয়া টানানো, নীচে চেয়ার পাতা। ব্যবসায়ী, বড় বড় অফিসার এবং শহরের সন্মানিত ব্যক্তির বসেছেন ওখানে।

প্রথম সারিতে বসে আছেন কায়রোর মসজিদ সমূহের ইমামগণ এরা সকলেই আয়ুবীর শ্রদ্ধাভাজন। ধর্মীয় গুরু এবং আলেমদের তিনি বেশী ভালবাসেন। অনুমতি ছাড়া তাদের মজলিসে বসেন না।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সবার সাথে সুস্পর্ক গড়ে তুলতে।

এ সচিবদেরই একজন খাদেমুদ্দীন আল বারক। আলী বিন সুফিয়ানের পর সুলতানের সবচে বিশ্বস্ত ব্যক্তি। রাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীর সকল গোপন পরিকল্পনা তিনি জানেন। যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং ম্যাপ থাকত তার কাছে।

খাদেমুদ্দীন আল বারকের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। দেহে আরবীয় সৌষ্ঠব। সপ্রতিভ, সুপুরুষ।

মঞ্চে তার পাশে এসে বসল একটা মেয়ে। অপূর্ব সুন্দরী। যুবতীর সাথে এসেছে একজন পুরুষ। বয়স ষাটেরও বেশী। ধনাট্য ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে তাকে।

সামনের দিক থেকে চোখ সুরিযে যুবতী বার বার তাকাচ্ছে আল বারকের দিকে। কয়েকবারই মেয়েটার তাকানো লক্ষ্য করলেন আল বারক।

যুবতী আবার তাকাল তার দিকে। চোখাচুখি হতেই সুন্দর করে হাসল মেয়েটা। এভাবে বেশ কবার চোখাচুখি হল তাদের, প্রতিবারই মিষ্টি মধুর হাসি উপহার পেল আল বারক। আবারো হাসতে যাবে, সাথে আসা বুড়োর দৃষ্টি পড়ল তার ওপর, সাথে সাথে ঠোঁট থেকে হাসি উবে গেল মেয়েটার।

দর্শকদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল ঘোড়সওয়াররা। এগিয়ে আসছে উষ্ট্রারোহী বাহিনী।

উটগুলোকে সাজানো হয়েছে রঙবেরঙের কাপড় দিয়ে। বাঁকানো ঘাড়ের শীর্ষে গর্বোদ্ধত মাথা। আরোহীদের হাতে দীর্ঘ বাটঅলা বল্লম। ফলার খানিক নীচে তিন ফিট চওড়া এবং দেড় ফিট লম্বা রঙিন কাপড় বাধা। উড়ছে বাতাসে। সওয়ারের কাঁধে ধনু। উটের পালানে বাধা রঙীন তুনীর। আরোহীদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। হাবভাবে রাজসিক ভাব।

উটগুলো দেখতে দর্শকদের উটের মত হলেও ওগুলো যে সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত ওদের ছন্দোবদ্ধ গতি দেখলেই তা বোঝা যায়। চলনে এমন একটা রাজসিক ভাব, মনে হয় ভিন গ্রহ থেকে এসেছে।

আল বারক আবার চাইল মেয়েটার দিকে। চোখে চোখ রাখল। মেয়েটার চোখ থেকে একই সাথে ঝরে পড়ছে আত্মনিবেদন, আকুতি আর নীরব আমন্ত্রণ।

বিদ্যুৎ খেলে গেল আল বারকের শরীরে। যুবতীর ঠোঁটে ভেসে উঠল লাজনম্র হাসি। বুড়োর দিকে দৃষ্টি পড়তেই যুবতীর চোখে মুখে নেমে এল একরাশ ঘৃণা ও হতাশা।

আল বারকের স্ত্রী চার সন্তানের জননী। এ মুহুর্তে স্ত্রীর কথা ভুলে গেলেন তিনি। তাকিয়ে রইলেন যুবতীর দিকে। বাতাসে উড়ছে সুন্দরীর রেশমী নেকাব। কখনও এসে পাশে বসা আল বারকের বুকে, মুখে লুটিয়ে পড়ছে।

আল বারক আলতো হাতে সরিয়ে দিল সে কাপড়। লজ্জা জড়ানো কষ্ঠে ক্ষমা চাইল যুবতী।

মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, ‘আরে না না, এতে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে?”

উষ্ট্রারোহীদের পেছনে পদাতিক ফৌজ, তীরন্দাজ আর তলোয়ারবাজ। পরনে সামরিক পোশাক। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল দর্শকরা। প্রতিটি সৈনিকই সুঠাম দেহী। চেহারায় আনন্দের দ্যুতি।

গর্বোদ্ধত বুকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। দর্শকরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। সুলতান আয়ুবী তা-ই চাইছিলেন।

সবশেষে এল সাজোয় বাহিনী। প্রতিটি কামানের পেছনে একটা করে এক্কাগাড়ী। গাড়ীতে বড় বড় পাথর এবং বিভিন্ন সাইজের ভাড়। ভাড়ে দাহ্য পদার্থ।

ধীরে ধীরে দর্শকদের সামনে দিয়ে এরাও পেরিয়ে গেল।

দীর্ঘ চক্কর দিয়ে ফিরে এলেন সুলতান আয়ুবী। সামনে পতাকাবাহী। ডানে, বায়ে এবং পেছনে গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা। তারও পেছনে সেনাপতিদের ঘোড়া।

সুলতান ঘোড়া থামালেন। দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে সালাম দিয়ে লাফিয়ে নামলেন ঘোড়া থেকে। চলে গেলেন চাঁদোয়ার নীচে।

দাড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল সবাই। তিনি সালামের জবাব দিয়ে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলেন।

আরোহী এবং পদাতিক সৈন্যরা পাহাড়ের আড়াল হয়ে গেল। ফাঁক ময়দান। এক দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার মাঠে প্ররেশ করল। একহাতে ঘোড়ার বলগা, অন্যহাতে উটের রশি। মধ্য মাঠে এসে ঘোড়ার পিয়ে দাড়িয়ে পড়ল সওয়ার। লাগাম ছেড়ে দিয়ে উটের পিঠে লাফিয়ে পড়ল।

আবার ফিরে এল চলমান অশ্বের পিঠে। এরপর লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। ঘোড়া এবং উটের সাথে ছুটে গেল কিছুদূর। আবার একলাফে ছুটন্ত ঘোড়ায় উঠে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল।

সামান্য ডানে ঝুকলেন আল বারক। তার মুখ এবং মেয়েটার মাথার-মাঝে দু’তিন ইঞ্চি ফাঁক। মেয়েটা তাকে দেখল। হাসল আল বারক। মেয়েটার ঠোঁটে এখনো সেই লাজুক হাসি। এদিকে চোখ পড়তেই কপাল কুঞ্চিত হল বৃদ্ধের। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।

সহসা পাহাড়ের দিক থেকে উড়ে এল কতগুলো মাটির পাতিল। মাঠে পড়ে ফেটে গেল পাতিলগুলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তরল পদার্থ। আশপাশে একশ গজ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। ভিজে গেল মাঠ।

পাহাড়ের টিলায় ভেসে উঠল দু’জন তীরন্দাজের মুখ। আগুনের ফিতা বাধা তীর ছুড়ল ওরা। ভেজা মাঠে তীর পড়তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন।

একদিক থেকে ছুটে এল চারজন ঘোড়সওয়ার। আগুনের কাছে এসেও থামল না। তীব্র গতিতে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া। অবাক দর্শকরা ভাবল ওরা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটতে দেখা গেল ওদের। বেরিয়ে গেল অপর দিক দিয়ে।

দর্শকদের শ্লোগানে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। দু’জন আরোহীর কাপড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। ছুটন্ত ঘোড়া থেকে লাফ দিল ওরা। গড়গড়ি খেল বালিতে। নিবে গেল পোশাকের আগুন।

আল বারকের দৃষ্টি মাঠে নেই। বার বার তাকাচ্ছে যুবতীর দিকে। প্রতিবারই মিষ্টি করে হাসছে তরুণী। আবার দৃষ্টি ফিরে যাচ্ছে বুড়োর দিকে। হঠাৎ বৃদ্ধ উঠে গেলেন। মেয়েটাকে তার সাথে আসতে দেখেছে আল বারক |

তোমার আব্বা উঠে গেলেন কেন? প্রশ্ন করলেন তিনি।

বৃদ্ধ আমার পিতা নন, স্বামী।

স্বামী!’ আল বারকের কষ্ঠে অবাক বিস্ময়। তোমার পিতা মাতাই, কি এ বিয়ে দিয়েছেন!’

সে আমায় কিনে নিয়েছে। যুবতীর নিঃস্পৃহ জবাব।

গেলেন কোথায়?

আপনার সাথে আমার চোখাচোখির ব্যাপারটা আঁচ করে রাগ করে চলে গেছেন। সন্দেহ করছেন আপনার জন্য আমার আকর্ষণ রয়েছে।’

সত্যিই কি আমার জন্য তোমার আকর্ষণ রয়েছে।’

লজ্জায় নত হল যুবতীর চোখ। ঠোঁটে বিনম্র হাসি। অক্ষুট কষ্ঠে বলল, ‘ওকে আর সহ্য করতে পারছি না। হাফিয়ে উঠেছি। কেউ আমাকে এ বুড়োর হাত থেকে মুক্তি না দিলে আত্মহত্যাই করব।

মাঠে সৈন্যরা সেনা নৈপূণ্য দেখাচ্ছিল। মল্লযুদ্ধ, অসি চালনা, তীরন্দাজী। দর্শক এ ধরনের ক্রীড়ানৈপুন্য আগে কখনও দেখেনি।

এতকাল এরা দেখে এসেছে সুদানীদের। ওদের হামবড়া ভাবের অন্ত ছিল না। অফিসাররা রাস্তায় বেরুত রাজ রাজড়ার মত। তাদের সংগী সেনাদল গ্রামবাসীদের বিপদের কারণ হয়ে দাড়াত।

চারণভূমি থেকে ওরা লুট করত পশু। কারো কাছে ভাল জাতের উট বা ঘোড়া থাকলে জোর করে নিয়ে যেত। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, সেনাবাহিনী তৈরী করা হয় জনগণের উপর অত্যাচার করার জন্য।

কিন্তু সালাহউদ্দীন আয়ূবীর ফৌজ ছিল তারচে ভিন্ন। যারা মহড়ায় অংশ নেয়নি, তাদের ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দর্শকদের মাঝে। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে ফৌজ তাদেরই ভাই এবং বন্ধু। শৃঙ্খলা ভংগকারী সৈনিকদের জন্য ছিল কঠোর শাস্তি।

আল বারক মহড়া সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লেন। ভুলে গেলেন সুলতানের নির্দেশ। যুবতী তার বিবেকের উপর চেপে বসল।

আল বারক তাকে ভাললাগার কথা বললেন। আহবানে সাড়া দিল যুবতী। একান্তে দেখা করতে বললেন আল বারক।

যুবতী বলল, আমি তার কেনা বাঁদি ও আমাকে বন্দী করে রেখেছে। তার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে আসা সম্ভব নয়। ঘরে তার চারজন স্ত্রী। ওরাও আমার উপর দৃষ্টি রাখে।

স্বীয় পদমর্যাদার কথা ভুলে গেলেন আল বারক। টিনেজারদের মত সাক্ষাতের জন্য বিভিন্ন স্থানের নাম উল্লেখ করতে লাগলেন। একটি স্থান তরুণীর পসন্দ হল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পড়োবাড়ী। শহরের বাইরে। ভবঘুরেরাই কেবল ওখানে যায়।

ঠিক আছে, আমি ওখানে আসতে পারি, যদি আপনি আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচানোর ওয়াদা দেন।

অবশ্যই। ঐ বুড়োর হাত থেকে তোমাকে মুক্ত করার ওয়াদা করছি আমি।

কখন আসব?

আজ রাতে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন। কি, আসবে তো?

মেয়েটি আবারো সেই সলজ্জ হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা’।

ООО

কায়রোতে রাত নেমেছে।

মেলা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে | দর্শকরা যে যার বাড়ী ফিরে গেছে। অস্থায়ী পতিতালয়গুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে সরকারী নির্দেশে। সন্দেহজনক পুরুষ ও নারীদের খুঁজছিল গোয়েন্দারা।

মেলার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দু’দিনে চার হাজার যুবক সেনা ফৌজে ভর্তি হয়েছে।

আল বারক চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পরনে সাধারণ পোশাক। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন কেউ দেখছে কিনা। না, কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই বুঝতে পেরে নিশ্চিন্তে রওনা দিলেন পুরনো সেই ভাঙা বাড়ীর দিকে।

ঘুমিয়ে পড়েছে মরুভূমি। রাতের নিস্তব্ধত ভেঙে থেকে থেকে ডেকে উঠছে পাহাড়ী শেয়াল। মেয়েটা বলেছিল সে বন্দিনী। সবসময় চোখে চোখে রাখা হয়। তবুও আসবে এ আশায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আত্মরক্ষার জন্য একটা খঞ্জর সাথে নিয়েছেন।

নারীর পাগল করা রূপের মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। হৃদয় হয় ভয় শূন্য। আল বারক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ হলেও এখন অবিবেচক যুবক।

ভাঙা বাড়ীটার কাছে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে, আপাদমস্তক ঢাকা। ছায়াটা মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ভাঙা দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকে গেলেন ভেতরে।

অন্ধকার কক্ষ। পাখা ঝাপটানোর শব্দ হল। হঠাৎ গালে চড় মারল কেউ। সাথে সাথে ভেসে এল চি, চি, শব্দ। বাদুড়। ওরা বড় বড় নখ দিয়ে মুখ আঁচড়ে দেবে ভেবে ভয় পেয়ে বসে পড়লেন তিনি।

বাদুরগুলো উড়ে বেড়াতে থাকল। ভয় পেয়ে হামাগু তু দিয়ে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে। উড়ন্ত বাদুড়ে ভরে গেল কক্ষ। চি চি শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এল বাদুড়গুলোও।

সতর্ক প্রহরায় থাকা এক বন্দিনী যুবতী কি কর এ ভয়ংকর পড়োবাড়িতে আসবে এ কথা তিনি একবারও ভাবলেন না। উঠোনে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।

কারো পায়ের ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল। খঞ্জর হাতে তুলে নিলেন তিনি। মাথার উপর বাদুড় উড়ছে, পাখা ঝাপটানোর শব্দ হচ্ছে। আল বারক চাপা কষ্ঠে ডাকলেন, ‘আছেফা।’

এ নামই তাকে বলেছিল মেয়েটা।

‘আপনি এসেছেন!’ আছেফার কষ্ঠ।

ছুটে এসে আল বারকের সামনে দাড়িয়ে বলল, শুধু আপনার জন্যই এ ভয়ংকর স্থানে এসেছি। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। বুড়োকে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। দেরী হলে জেগে উঠতে পারে।’

মদের সাথে বিষ মিশাতে পারলে না?”

‘আমি কখনও মানুষ হত্যা করিনি। একজন পর-পুরুষের সাথে এভাবে ভয়ংকর স্থানে আসব, তাও কি ভেবেছি কখনো!

আল বারক যুবতীকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। হঠাৎ পেছনের পথ আলোময় হয়ে উঠল। তার আগমন পথে জ্বলে উঠল দু’টো মশাল। এক ঝটকায় আছেফাকে পেছনে নিয়ে এলেন তিনি। এরা কি প্রেতাত্বা না মেয়েটার পেছনে এসেছে, ভাবছেন আল বারক।

গর্জে উঠল একটা কণ্ঠ, দু’টোকেই জবাই করে ফেল।

মশাল নিয়ে এগিয়ে এল চারজন বলিষ্ঠ জোয়ান। একজনের হাতে বর্শা, তিনজনের হাতে তরবারী।

মশাল মাটিতে পুতে দিল ওরা। আলোয় ভরে গেল আঙ্গিনা। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মত ওরা আল বারকের চার পাশে ঘুরতে লাগল। আছেফা তার পেছনে।

বারান্দা থেকে শব্দ এল, পেয়েছো? জীবন্ত ছেড়ো না কাউকে। মেয়েটার বুড়ো স্বামীর আওয়াজ।

আছেফা পেছন থেকে সামনে চলে এল। ঘৃণা এবং ক্ৰোধকম্পিত কষ্ঠে বলল, ‘এসো, এগিয়ে এসো। খুন কর আমাকে। এ জীবনে আমার আর বাঁচার সাধ নাই। বুড়ো পাঠা, টাকার জোরে আমার জীবনটা তুমি ধ্বংস করে দিয়েছো।

আমার এ যৌবনকে তুমি কি দিতে পেরেছ? আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি, আল্লার গজব পড়বে তোমার ওপর। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি। ওকে আমিই এখানে আসতে বলেছি

আছেফা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে।

ওদের ঘিরে দাড়িয়ে আছে চারজন সশস্ত্র লোক। বর্শাধারী এগোল আছেফার দিকে। বর্শার ফলা তার পেটে ঠেকিয়ে বলল, ছিনাল মাগী, আর একটা কথাও না। মরবি তো মর, তার আগে ফলাটা দেখে নে। জাহান্নামে তোর নাগরকে আগে পাঠাব, না তোকে?

এক ঝটকায় বর্শা ধরে ফেলল আছেফা। হ্যাচক টানে কেড়ে নিয়ে আল বারক থেকে সরে গেল খানিক। এরপর বর্শা উচিয়ে বলল, আয়, এগিয়ে আয়। দেখি একে আমার আগে কে হত্যা করে।’

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত। আল বারক খঞ্জর হাতে এগিয়ে এলেন। মেয়েটা বর্শাধারীকে আক্রমণ করল। পিছিয়ে গেল সে।

তার সংগীরা আল বারককে আক্রমণ না করে আক্রমণের পায়তারা করছিল। ইচ্ছে করলে ওরা অনেক আগেই তাকে হত্যা করতে পারত।

আছেফা ধমকাচ্ছিল। আঘাত করছিল লক্ষ্যহীন ভাবে।

আল বারক এক ব্যক্তিকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল। তার পেছনে ছুটে এল দু’জন, একলাফে আছেফা ওদের পেছনে চলে গেল। ইচ্ছে করলে বর্শা মেরে ওদের ঘায়েল করতে পারত আছেফা। কিন্তু খঞ্জর দিয়ে তরবারীর মোকাবিলা করা যায় না।

বুড়ো একদিকে দাড়িয়ে হস্বিতম্বি করছিল। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে কেটে গেল কিছু সময়। কেউ আহত হয়নি। আঁচড়ও লাগেনি কারও গায়ে। এবার বৃদ্ধ বলল, থামো!

যুদ্ধ থেমে গেল।

‘এমন বিশ্বাসঘাতিনীকে আমি আর বাড়ীতে নেবো না। জানতাম না ও এত দজাল। জোর করে নিয়ে গেলে কখন আমাকে মেরেই ফেলবে!’

আমি তোমাকে এর মূল্য পরিশোধ করে দেব। আল বারক বলল, ‘তুমি একে কত দিয়ে কিনেছিলে?

আমার সম্পদের অভাব নেই। ওকে আমি আপনাকে উপহার দিলাম। আমি অবাক হচ্ছি আপনার প্রতি ওর ভালবাসা দেখে। কি পরিমাণ ভালবাসা থাকলে নিজের জীবন বিপন্ন করে এতগুলো লোকের মোকাবিলা করতে পারে একবার ভেবে দেখেছেন? ও যুদ্ধবাজ বংশের মেয়ে তো, এক যোদ্ধার ঘরেই ওকে মানাবে ভাল।

তাছাড়া আপনি প্রশাসনের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। সুলতানের এক অনুরাগী হিসাবে আপনাকে আমি অসন্তুষ্ট করতে পারিনা। আমি ব্যবসায়ী মানুষ, সারাদিন ব্যস্ত থাকি বাইরে। আর এ বুড়ো বয়সে ওর মত যুবতী ঘরে রাখাও বিপদজনক। আমি ওকে তালাক দিলাম। এবার ও আপনার জন্য বৈধ।’,

করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল সে। অন্ত্রধারীদের দিকে ফিরে বলল, এই চল, খবরদার, এই ঘটনা কাউকে বলবি না।

লোকগুলো মশাল তুলে ফিরে গেল। অবাক চোখে ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন আল বারক। তার পায়ের নীচে মাটি কাঁপতে লাগল। কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বৃদ্ধ তার সাথে প্রতারণা করেছে। পথে লুকিয়ে থেকে দু’জনকেই হত্যা করবে।

আছেফার হাত থেকে বর্শা হাতে নিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন ভাঙা বাড়ি থেকে। –

আছেফার হাত ধরে দ্রুত হাটছিলেন তিনি। বারবার তাকাচ্ছিলেন ডানে, বায়ে, পেছনে। সামান্য শব্দেও চমকে উঠে থেমে যেতেন। অন্ধকারেই চাইতেন এদিক ওদিক। ধীরে ধীরে হাঁটা ধরতেন আবার। শহরে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

আছেফা থামল। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি কি আমায় বিশ্বাস করেন!’

আল বারক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগের কারণে কিছুই বলতে পারলেন না।

এ ঘটনার পর দেখা গেল আল বারক নয়, মেয়েটাই তাকে কিনে নিয়েছে। তার মনে হচ্ছিল আছেফা তার জন্য পাগল। শুধু তার জন্য এতগুলো লোকের সাথে একা লড়াই করেছে আছেফা।

আছেফা তার রূপের জালে আটকে ফেলেছে তাকে। আল বারক স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। সে স্থান দখল করল আছেফা।

সে যুগে মেয়েদের ক্রয় বিক্রয় চলত। স্ত্রীর কোন মর্যাদা ছিল না। চারজন স্ত্রী রাখাকে পুরুষের অধিকার মনে করা হত। বিত্তশালীরা পুষত রক্ষিতা। মুসলমান ওমরাদেরকে নারীরাই ধ্বংস করেছে। স্বামীদের সন্তুষ্ট করার জন্য স্ত্রীরাই সুন্দরী মেয়ে খুঁজে এনে স্বামীদের উপহার দিত।

আল বারক আছেফাকে নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সবাই তখন ঘুমিয়ে। সকালে স্ত্রী দেখল স্বামীর বিছানায় এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবতী। এতে সে মোটেই অসন্তুষ্ট হলোনা। ভাবল, এমন দু’একজন স্ত্রী বা রক্ষিতা পোষার ক্ষমতা তার স্বামীর রয়েছে। ও আসায় তার কিছুটা দায়িত্ব বরং কমবে। কিন্তু একবারও ভাবল না, আজ থেকে তার ভালবাসা হারিয়ে গেছে।

একদিন যে মেয়েরা পুরুষের সাথে কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এখন তারা শুধুমাত্র পুরুষের ভোগের সামগ্রী- এ কথা ভাবতে কষ্ট হতো আয়ুবীর। এতে সমাজের অর্ধেক শক্তিই নিঃশেষ হয়নি বরং এরা জাতির পৌরুষকেও নিঃশেষ করে দিয়েছে।

ব্যবসায়ী পণ্যের মত মেয়েদের নিলাম হত। অপহরণ, খুন ধর্ষণের ঘটনা ঘটত অহরহ। তিনি নারীদের এ অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলেন।

নারীকে পুরুষের এবং পুরুষকে নারীর এই অনাহুত মোহ থেকে মুক্ত করতে তিনি ‘এক স্বামীর এক স্ত্রী শ্লোগান তোললেন। তিনি জানতেন দু’তিনজন স্ত্রী এবং রক্ষিতার মালিক আমীর ওমরারা সরাসরি এর বিরোধিতা করবে। কারণ, এরাই ছিল নারীদের প্রধান খরিদার।

নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সালাহউদ্দীন কুমারী মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলেন। এতে হারেমগুলো শূন্য হবে। নারী ফিরে পাবে মর্যাদা। কিন্তু পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে না আসা পর্যন্ত তা সম্ভব ছিল না।

সমাজে তার শত্রুর পরিমাণ ছিল যথেষ্ট। তিনি জানতেন, বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি জানতেন না তাঁর বিশ্বস্ত সংগী, রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক গোপন পরিকল্পনার রক্ষক আল বারকও এক রূপসীর ফাঁদে পড়েছেন। প্রেমের অভিনয় দিয়ে যে রূপসী তাকে আপন কর্তব্য ভুলিয়ে দিচ্ছিল। –

ΟΟΟ

সেনা মহড়া দেখেছে জনগণ। আয়ুবীর সামরিক শক্তি দেখে ভীত হয়নি, বরং খুশী হয়েছে তারা।

বক্তৃতা বিবৃতিতে বিশ্বাসী নন সালাহউদ্দীন আয়ুবী, কিন্তু মহড়ায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। জনতার সামনে খ্রীস্টানদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, আরবের মুসলমান আমীর ওমরাগণ ভোগবিলাসে মত্ত। সাধারণ মুসলমান খ্ৰীষ্টানদের অত্যাচারে জর্জরিত। খ্ৰীষ্টানরা কাফেলা লুণ্ঠন করে। অপহরণ করে মুসলিম যুবতীদের। ওদের আব্রু ইজ্জত হরণ করার পর বিক্রয় করে দেয়।

সুলতান জনতাকে জাতীয় চেতনাবোধে উজ্জীবিত করতে চাইলেন। মা বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করলেন যুবকদের।

সালাহউদ্দীন আয়ুবীর আগুন ঝরা বক্তৃতায় আবেগে উদ্বেলিত হল দর্শকরা। সেদিন থেকেই সেনাবাহিনীতে নতুন ভর্তি শুরু হল।

দশদিনের মধ্যে নতুন ভর্তি দু’হাজারে গিয়ে পৌছল। এরমধ্যে দেড়হাজার নিয়ে এসেছিল উট, একহাজার ঘোড়া এবং খচ্চর। সুলতান পশুর দাম চুকিয়ে দিলেন। শুরু হল ওদের সামরিক প্রশিক্ষণ। মেলার তিন মাস পর। দেখা গেল সেনাবাহিনীতে তিনটি অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। চুরি, জুয়া এবং রাতে যেখানে যার থাকার কথা সেখানে না থাকা।

তিনটি অপরাধের মুল ছিল জুয়া। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের ব্যক্তিগত জিনিস চুরি করে বাজারে বিক্রি করে ফেলত।

এক রাতে তিনটি ফৌজি ঘোড়া হারিয়ে গেল, অথচ দেখা গেল সৈন্যদের কেউ অনুপস্থিত নেই। ফলে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হল না। আরেক রাতে দেখা গেল দশটি ঘোড়া নেই।

সৈন্যদের শাস্তির ভয় দেখানো হল কিন্তু অপরাধ কমল না।

একরাতে এক সৈনিককে গেটের বাইরে দেখা গেল। মাতালের মত তার পা কাপছে। সেন্ট্রি ডাকল তাকে। দাঁড়াল সিপাইটি। এরপর এগিয়ে আসতে গিয়ে ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল।

এগিয়ে গেল সেন্ট্রি। সৈন্যটির দেহ রক্তে ভেজা। সেন্ট্রি তাকে সুবেদারের কাছে নিয়ে গেল। চিকিৎসা করা হল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।

মৃত্যুর আগে সে বলল, ‘একজন সিপাইকে আমি হত্যা করে এসেছি। ক্যাম্প থেকে আধা মাইল উত্তরে এক তাবুতে পড়ে আছে তার লাশ ‘ ‘

ওখানে ছিল তিনটি বেদুঈন তাবু। ওদের কাছে রয়েছে সুন্দরী যুবতী। দিনে সেজেগুজে ক্যাম্পের চারপাশে হাটত যুবতীরা। রাতে। সৈন্যরা ওদের কাছে চলে যেত। একজনের কাছে শুনে আরেকজন।

এরা কোন সাধারণ পতিতা ছিল না। প্রতিটি খন্দেরের সাথে ওরা প্রেমের অভিনয় করত। কে কখন আসবে বলে দিত যুবতীরা।

দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন এক যুবতীর তাবুতে এক সাথে দু’জন সৈনিক এসে হাজির হল। এদের দু’জনের সাথেই অভিনয় করছিল যুবতী।

দু’জনই ওকে পাওয়ার জন্য ছিল উদগ্রীব।

সে রাতে দু’জন একসঙ্গে তাবুতে পৌছে মেয়েটাকে নিজের ‘অধিকারে নেয়ার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ল। সংঘর্ষে একজন হল নিহত, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে এসে মারা গেল।

একজন কমান্ডার কয়েকজন সিপাই নিয়ে লাশের জন্য ওখানে গেল। গিয়ে দেখে লাশ পড়ে আছে, কিন্তু তাবু নেই।

সৈন্যটার লাশ নিয়ে ফিরে এল সিপাইরা। রাতে আর খোঁজাখুজিতে গেল না। আয়ূবীর কাছে রিপোর্ট করা হল। বলা হল, সৈন্যদের মাঝে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কেন অপরাধ বৃদ্ধির পাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে আলীকে হুকুম দিলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। গোয়েন্দাদের তৎপর হতে বললেন এ কাজে। আল বারককে বললেন, আপনিও একটু খোঁজ খবর নেন। শহরের এমন জায়গায় ছিল এ কেনো’র জবাব, যেখানে যেতে পারত না আলীর গোয়েন্দারা।

শহরের কেন্দ্রে কেল্লার মত বিশাল বাড়ী। মিসরের একটা পরিবার নয় বরং একটা বংশের সকলেই ওখানে থাকত।

এরা ছিল অভিজাত ও সম্মানিত। ওদের দানের হাত ছিল উন্মুক্ত। এতিম, বিধবা এবং গরীবরা কখনো ওখান থেকে শূন্য হাতে ফিরত না। এ বংশের সবাই ছিল ব্যবসায়ী। মহড়ার সময় সেনাবাহিনীকে আশরাফি দিয়েছিল দুই থলে ভর্তি করে।

সালাহউদ্দীন মিসরে আসার আগে সুদানী ফৌজের বড়বড় অফিসাররা এখানে এসে সময় কাটাত। সুদানীরা নিশ্চিহ্ন হরার পর এরা আয়ুবী সরকারের অনুগত হয়ে পড়ল।

সুলতান যখন আলী এবং আল বারককে নির্দেশ দিচ্ছিল সে রাতে ওই বাড়ীর এক কক্ষে চলছিল জমজমাট মদের আসর। আসরে বসেছিল বার জন যুবক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।

কক্ষে প্রবেশ করল এক বৃদ্ধ। সাথে একদল সুন্দরী। এদের মধ্যে এক যুবতীর মুখ নেকাবে ঢাকা।

উঠে দাড়াল সবাই। ওরা কক্ষে ঢুকতেই দরজা বদ্ধ করে দেয়া হল। নেকাব খুলে বৃদ্ধের পাশে এসে বসল মেয়েটা।

ফৌজে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদ গতকাল সুলতানের কানে দেয়া হয়েছে। বৃদ্ধ বলল, এজন্য আমাদের আজকের এ বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজে গোয়েন্দাদেরকে অন্তৰ্ভূক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে সুলতান।

‘আমরা ওদের তৎপরতা সফল হতে দিতে পারি না।’ বলল একজন |

‘তোমাদের জন্য সুসংবাদ হল দু’জন মিসরী সৈন্য এক যুবতীকে নিয়ে ঝগড়া করেছে। নিহত হয়েছে একজন, অন্যজন আহত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে মারা গেছে, এ আমাদের প্রথম সাফল্য।’

তিন মাসে নিহত হল মাত্র দু’জন। এত ধীরগতির সফলতায় সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। যখন আয়ুবীর এক সালার আরেক সালারকে হত্যা করবে তখনই শুধু বলা যাবে আমরা সফল হচ্ছি।’ বলল অন্য একজন।

কোন সেনাপতি বা কমান্ডার যদি আয়ুবীকে হত্যা করে তবেই আমরা সফল। বৃদ্ধের কণ্ঠ, একহাজার সৈন্য নিহত হলেও কিছু যায় আসে না। আমাদের লক্ষ্য আয়ুবী। গত বছরের কথা তো তোমরা জান, আয়ুবীর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। রোম থেকে আসা লোকগুলো সব মারা পড়ল। ওদের দলের এক হারামী মুসলমান হয়ে গেল। এতে বুঝা যায়, আয়ুবীকে হত্যা করা এত সহজ নয় যা তোমরা মনে কর।’

এওতো হতে পারে, আয়ুবীকে মারলে তার স্থান দখল করবে তারচে গোড়া কোন ব্যক্তি? বাগদাদ ও দামেশকের আমীরদেরকে যেমন যুবতী মেয়ে দিয়ে ধ্বংস করেছি, আয়ুবীর ফৌজকেও সেভাবে নষ্ট করতে হবে।’

খ্রিস্টান এবং সুদানীরা পরাজিত হয়েছে এক বছর হল, একজন বলল, “এ এক বছরে আপনারা কি করেছেন? আপনারা যে পথে এগুচ্ছেন এ পথ বড় দীর্ঘ। এ মুহুর্তে দু’জনকে হত্যা করা অত্যন্ত জরুরী। একজন আয়ুবী, অন্যজন আলী বিন সুফিয়ান।

আপনি ঠিক বলেছেন। আলীকে হত্যা করলে আয়ুবী অন্ধ হয়ে যাবে।” সমর্থন জানাল এক যুবক।

‘আয়ুবীর বুকের সব গোপনীয়তা দেখার চোখ এখন আমাদের হাতে। বৃদ্ধ যুবতীর পিঠ চাপড়ে বলল, এ হল সে চোখ। এর চোখের যাদু দেখে নাও। তোমরা আল রিক নামে সালাহউদ্দীনের এক সচিবের নাম শুনেছ। কেউ কেউ তাকে দেখেও থাকবে। আয়ুবীর হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে মাত্র দু’টো লোক, আলী এবং আল বারক। আলীকে হত্যা করা হবে বোকামী।

আল বারকের মত আমরা তাকেও হাত করে নেব।” আল বারক হাতে এসেছে?”

বুড়ো যুবতীর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “এ শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলেছি। তোমাদের এই সুসংবাদ শোনানোর জন্যই আজ ডাকা হয়েছে।’

“কি বলছেন আপনি! এ অসাধ্য কি করে সাধন করলেন?” বিস্মিত প্রশ্ন করল বিড়ালমুখো ঢেঙ্গাপাতলা এক লোক।

‘আলী এবং আল বারককে ফাসানোর জন্য আমি এক বছর ধরে ঘুরছি। পারিনি। সেনা মহড়ার দিন এক অভাবিত সুযোগ ঘটে গেল। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য মঞ্চে উঠলাম। আলী বিন সুফিয়ানকে দেখলাম না আশপাশে, তবে আল বারককে পেলাম।

যুবতীকে দেখিয়ে বলল, ‘একে তো তোমরা চেনই, ওকে পুরুষ ধরার ট্রেনিং দিয়েছি দীর্ঘদিন। সে ট্রেনিং এবার কাজে লাগাবার পালা।

ওকে তার পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আমি সরে যেতেই তার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল ও। আমাকে অত্যাচারী বৃদ্ধ স্বামী বানিয়ে আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ও তার সাহায্য চাইল। তার মায়াবী রূপের জালে আটকে গেল আল বারক। গোপনে ওরা সাক্ষাৎ করল। সাক্ষাতের স্থানে আমরা একটা নাটক করলাম।

আমাদের লোকেরা তরবারী এবং বর্শা নিয়ে আক্রমণ করল ওদের। তার মোকাবেলায় রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করল ও। আল বারক ভেবেছে মেয়েটা তার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতসব করছে। অথচ বেকুবটা একবারও ভাবল না, এত লড়াইয়ের পরও দুই পক্ষের কেউই আহত হয়নি কেন। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে তার হাতে তুলে দিলাম।



সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনী

 -  “আপনি যদি একটি জাতিকে কোনরকম যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করে দিতে চান, তাহলে তাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে অশ্লীলতা আর ব্যাভিচারের প্রচলনের ব্যবস্থা করে দিন।” “নেতারা যে জনগনের নেতৃত্বে থাকে, সেই মানুষদের চেয়ে যখন নিজেদেরকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়, তারা সেই পদের জন্য তখন আর যোগ্য থাকে না।” — সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী


সপ্তম শতকের শুরুতেই মিসর, বাইজেন্টাইন, ইরাক, ইরান, আফগান সহ জেরুজালেম ইসলামের পরিপূর্ন সাম্রাজ্য বিস্তার এবং শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ষষ্ঠ শতকে মহান বীর খালিদ বীন ওয়ালিদের হাতে। মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশায় বহু রাজ্য প্রধানের কাছে ইসলামের আহবান জানিয়ে পত্র পাঠান। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর ও আলকজানিন্দ্রায় রোমক শাসনকর্তা বাদশাহ জুরায়হ মকুকাশ ইবনে ইয়ামিনকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। হযরত হাহিব ইবনে আবি বালতা (রা) মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের দূত হিসেবে উক্ত পত্র নিয়ে মকুকাশের দরবারে পৌঁছেন। মকুকাশ দূতকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন। কিবতীদের মধ্যে সুখ্যাতির অধিকারী মরিয়ায়ে কিবতীয়া ও শিরীন নামে দুজন দাসী, মূল্যবান কাপড় এবং দুলদুল নামের একটি ঘোড়া উপঢৌকন হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি সুকৌশল এড়িয়ে যান। এভাবে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে সামিল হয় অনেকে করে বিরোধিতা। কিন্তু একসময় চিঠি পাঠানো সকল রাজ্যই মুসলমানদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর শাসনামলে হযরত আমর ইবনুল আস (রা) মিসরের রোমক শাসনকর্তাকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে গোটা মিসরকে ইসলামী শাসনাধীনে আনয়ন করেন। মিসর মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এ সময়ে আধুনিক কায়রোর নিকটবর্তী আল ফুততা নামক স্থানে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। উমাইয়া ও আব্বাসীয় বংশের শাসনের পর ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ফাতেমী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশের প্রথম শাসক জহর আল ফুসতাতের পরিবর্তে আল কাহিরা বা কায়রোতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রাজধানীকে সুশোভিত করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলমাদের ক্রমবর্ধমান বিজয় এবং শাসন ছিলো অব্যহত। এই সময়ের মধ্যে ইসলাম এবং ইসলামিক চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজ্য প্রসার, সেনাবাহিনী গঠনে মুসলমান অসামান্য ভূমিকা রাখে। এরপর শুরুহয় ইসলামের উপর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। যার মাত্রা ছিলো অত্যন্ত ভয়াবহ। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইউরোপিয়ান শাসকেরা একেএকে মুসলামদের কাছে রাজ্য হারিয়ে, মুসলমানদের অধীনে থেকে শাসন মেনে নিয়ে, তাদের পবিত্র ভুমিতে ইসলামের ব্যাপক চর্চায় যেমন ছিলো বিচলিত তেমনি আক্রোশে ছিলো জর্জরিত। এহেন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তারা গ্রহন করলো এক মহা কুটকৌশল। যার প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছেদ আর ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিমুখ করে মুসলিম সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ করা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা গঠন করলো গুপ্তচর বাহিনী, শুরু করলো মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা, নকল ইসলামী রীতি, মদ, জুয়া, নারীর ব্যবহার। অশ্লীলতা আর ব্যভিচার মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিতে ইসলাম বিদ্বেষীরা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্ব করে আগাতে থাকলো অত্যন্ত গোপনে আর প্রকাশ্যে আরম্ভ করলো ক্রুসেড। ক্রুসেডের প্রথম যুদ্ধেই জেরুজালেম মুসলমাদের হাত ছাড়া হয়। এর প্রায় ২০০ বছর পর জেরুজালেম আবার পুনরুদ্ধার করেন মুসলিম সেনাপতি, অকুতোভয় সেনা নায়ক, সুলতান গাজী সালাউদ্দীন আল আইয়ুবী। ঝড়গতি সম্পন্ন, আপোষহীন অকুতোভয় আইয়ুবী যখন ইসলামের তরবারি হাতে আবির্ভূত হন তখন ক্রুসেডের সাজানো কৌশল বারেবারে কেপে উঠে। চক্রান্তের জাল ছিড়ে জেরুজালেম ছিনিয়ে এনে শত বছরপর আবার মুসলমানদের হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসেন গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী। বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে ১১৩৭ সালে জন্ম গ্রহন করেন সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল লকব যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”। তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১০৯৯ সালে মুসলমানদেরকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম তাদের দখলে আনেন ইউরোপিয়ানরা। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল। বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। এটা ইউরোপিয়ানদের নিজ বিবরণ অনুযায়ী। শহরে কী নারী, কী পুরুষ, কী শিশু, কী বৃদ্ধ –যাকেই পাওয়া গেছে, তাকেই নিধন করা হয়েছে। বহমান রক্তে নাকী সেদিন ঘোড়ার খোর পিছলে যাচ্ছিল। এই ছিল নিধনের নৃশংসতা।বিজয় ধরে রাখা, পরবর্তী যুদ্ধাদি চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গডফ্রি জেরুজালেমের বাদশাহর পদে সমাসীন হন। অথচ হযরত ওমরের (রা.) খেলাফত কালে জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। বিজয় যখন মুসলমানদের আয়ত্তে তখন জেরুজালেমের অধিপতি পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাস । ওমর (রা.) পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের জানমাল ও ধর্মীয় নিরাপত্তার বিষয়াদি নিশ্চিত করেন। সেই হতে জেরুজালেমে সকল ধর্মের (ইয়াহুদী/খৃষ্টীয়ান) লোকজনের যাওয়া আসা, ইবাদত-আরাধনার নিরাপত্তা বিধিত হয় এবং এটা এভাবেই যুগপৎ হয়ে পড়ে। ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খ্রিষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্তের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর সর্বত্র। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকে যা হার মানায়। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ১১৯০ সালে তৃতীয় ক্রুসেড জয়ের পূর্ব পর্জন্ত ইহুদী, খ্রিস্টান, উপনেবেশিকরা সব ক্রসেডে মুসলমানদের ব্যাপকভাবে নিপীড়ন, নিষ্পেষণ চালায়। ১৩ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকা এই দখলদারিত্বে ইউরোপিয়ান শাসকেরা নানান রকমের অত্যাচার ও নির্যাতন করেন এবং সর্বোপরি যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে যে চরম মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা করেন তার জের এখনও শেষ হয় নি। ইউরোপ ও মুসলমানদের মধ্যে হাজার বৎসরের টানাপোড়নের সম্পর্ক এই যুদ্ধংদেহী তৎপরতার সৃষ্টি। ১১৬৩ সালে তার জেনগি বংশীয় ঊর্ধ্বতন নূরউদ্দিন জেনগি তাকে ফাতেমীয় মিশরে প্রেরণ করেন। ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে সালাহউদ্দীন ফাতেমীয় সরকারের উচ্চপদে পৌছান। ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১১৬৯ সালে তার চাচা শেরেকোহ মৃত্যুবরণ করলে আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তার উজির নিয়োগ দেন। ১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন। ১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা ও হিমস জয় করেন। জেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিল। এরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হন। ১১৮২ সালে আলেপ্পো জয়ের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন সিরিয়া জয় সমাপ্ত করেন। তবে জেনগিদের মসুলের শক্তঘাটি দখলে সমর্থ হননি। সালাউদ্দীনের সাথে ক্রুসেডারদের যুদ্ধ হয় ১১৮৭ সালে। এর কয়েক দশক আগে অপর এক ক্রুসেড যুদ্ধে এই মর্মে বিরতি আসে যে খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যাতায়াতে বাধা দেবে না, ব্যবসায় কাফেলাদেরকে এবং ধর্মীয় কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবেনা। এটাই প্রায় চার যুগ ধরে চলছিল। কিন্তু ১১৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি হজ্জযাত্রী কাফেলাকে রেনোল্ড আক্রমণ করেন, মালামাল লুট করেন এবং তাদেরকে মারধর করে জেলে নিক্ষেপ করেন। রেনোল্ডের উদ্দেশ্য ছিল সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামানো। অবস্থা এই ছিল যে জেরুজালেমের বাদশাহ বল্ডউইন কোষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে তার ভায়রা গী অব লুসিগনান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু গীর সে ধরনের তেমন কোন দক্ষতা ছিল না। তাই তার এক প্রাক্তন-মৈত্রী রেনোল্ড তার কাজে সহায়তা করতেন এবং ‘সুযোগও গ্রহণ করতেন’। রেনোল্ড একজন রক্ত-লিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন। তবে রেনোল্ড কর্তৃক ব্যবসায় কাফেলাকে ইতিপূর্বে হয়রানী করার অভিযোগও আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাই রেনোল্ড ইচ্ছে করেই সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামিয়ে চূর্ণ করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশেই একটি নিরপরাধ, নিরস্ত্র, হজ্জগামী কাফেলাকে আক্রমণ। এরই জওয়াব দিতে আসেন সালাউদ্দীন আইয়ূবী। ১১৮৭ সালে তিনি ক্রুসেডদেরকে দারুণভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর জেরুজালেমে প্রবেশ ও বিজয় ছিল রক্তহীন।


সালাউদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ ও বিকম্পন সৃষ্টি করে। পোপ ৩য় আর্বান হার্ট এটাক করে মারা যান। ক্রুসেডাররা তখনো ধারনা করতে পারেনি সালাউদ্দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আগমন করেছেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে খ্রিস্টানদের মহা বিপর্যয়ের পর মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পোপ ২য় আরবানুসের আহবানে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হল সমগ্র খ্রিস্টান শক্তি। ইংল্যান্ডের রিচার্ড দি লায়নহার্ট, ফ্রান্সের ফিলিপ অগাস্টাস আর জার্মানির ফ্রেডরিকের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান আক্রায় মুসলমানদের অবরোধ করা হয়। ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর মেয়াদী ৬ লাখ সৈন্যের এই বিশাল অবরোধ সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মাত্র ২০ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে প্রতিরোধ করেন। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর অবরোধ তুলে নিয়ে নিজদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে শতশত বছর কোন খ্রিস্টান সম্রাট শত চেষ্টা করেও বাইতুল মুকাদ্দাস আর দখল করতে পারেনি। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা চালায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদস। এভাবেই কুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এর পর দীর্ঘ প্রতিক্ষা, গোলামীর জিঞ্জির ভেংগে, জিল্লতির জীবন ছেড়ে মাথা তোলে দাঁড়াবার জন্য মুসলিম মিল্লাত অপেক্ষা করছিল একজন মুক্তিদূতের। ১০৯৯ সালের পরের কোন এক সময়, তখন আল কুদস ক্রুসেডারদের দখলে। বাগদাদ শহরে এক কাঠমিস্ত্রি থাকতেন।লোকটি মনের সকল ভালোবাসা দিয়ে খুব সুন্দর একটি মিম্বর বানালেন। মিম্বরটির সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক মিম্বরটি দেখতে আসতে শুরু করলো। অনেকেই মিম্বরটি কিনতে চাইতো, কিন্তু কাঠমিস্ত্রির জবাব ছিল এটি বিক্রির জন্য নয় এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য। তার কথাশুনে সবাই হাসতো। কাঠমিস্ত্রিকে পাগল ঠাওরাত। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। একদিন এক ছোট ছেলে তার পিতার হাত ধরে এসেছিল মিম্বরটি দেখতে এবং কাঠমিস্ত্রির কাছ থেকে তার স্বপ্নের কথাও জেনেছিল।ছোট ছেলেটি মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন সে পূরণ করবে। সময়ের ব্যবধানে সেই ছেলেটি মিম্বরটি আল আকসায় স্থাপন করেছিল। তিনি আর কেউ নয়, দিক বিজয়ী বীর সুলতান গাজী সালাউদ্দিন আইয়ূবী। ১৩ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্রুসেডের যুদ্ধ শেষ হলেও ইউরোপিয়ান পক্ষ তাদের মানসিকতা ও আচরণ থেকে ‘ক্রুসেড’ যেন সরাতে পারছেন না। এই বিংশ শতাব্দী ও একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম ভূখণ্ডে যেসব আক্রমণ চালানো হয়েছে; বেপরোয়া ভাবমূর্তিতে অসমতুল্য শক্তির প্রবল প্রয়োগে যে ধ্বংস লীলা চালানো হয়েছে এবং এগুলোতে যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে –এসব বাস্তবতার কীরূপ ব্যাখ্যা মুসলমানেরা গ্রহণ করবে সেটাই হয়ে পড়ে এক মুস্কিলের বিষয়। ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কায় পরমাণু বোমা হামলা চালানোর মতো বিষয়ে পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ কলেজে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালানোর কোর্সে এ বিষয়ে পড়ানো হয়। এসব বিষয় অত্যন্ত নাজুক। এসব বিষয় সামনে রাখলে ‘সভ্যতার’ আওয়াজ যে কত অন্তঃসারশূন্য তা সহজেই বুঝা যায়। সুলতান আইয়ুবী কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণে নেবার প্রায় ৮০০ বছর পর এবং ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের ৪৩ বছর পর মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক অনৈক্য ও দুর্বলতার ফলে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস আর মসজিদুল আকসা আবার চলে গেল বিধর্মীদের হতে। খ্রিস্টানদের মদদে সেখানে কর্তৃত্ব নিল অভিশপ্ত ইহুদী জাতি। ৮০০ বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল সেই পবিত্র মাটিতে। মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করল ফিলিস্তিনের মাটি। যা এখনো বিরাজমান।আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা ক্রন্দন করছে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য। ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সালাহউদ্দিন দামেস্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে এক টুকরো স্বর্ণ ও চল্লিশ টুকরো রূপা ছিল। তিনি তার অধিকাংশ গরিব প্রজাদের দান করে যান।দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরে তাকে দাফন করা হয়। যদিও সালাহঊদ্দীন বহুকাল পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন ,কিন্তু মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি আজও জীবিত ক্রুসেডের হৃদয়ে তিনি আতংক ,আর মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি খোদার আবর্তিত রহমত।

নিচে এই বই টির ডাউনলোড করার দুইটি লিঙ্ক আছে এবং প্রিভিউ লিঙ্ক ও আছে

কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন নিচে আমার ফেসবুক আইডি এর লিঙ্ক দেওয়া আছে.. যদি কোনো ভুল হয় ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন

Previous Post
Next Post

post written by:

Siddikur Rahman Rayhan from Bangladesh is a versatile individual with a keen interest in technology, cricket, politics, and Islamic studies. With a strong academic background and proficiency in multiple languages, he excels in blogging, YouTube, web development, Graphix Design and content creation. Skilled in video editing, meme generation, and photography, Rayhan is dedicated to personal and professional growth, seeking connections with like-minded individuals to support his endeavors.

0 Comments: